কেন এত ভয় ট্রাম্পকে নিয়ে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রায় সব জনমত জরিপ বলছে কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের লড়াই হবে সমানে সমান। দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে দুই পক্ষের প্রচারণা চলছে। দুই প্রার্থীর নীতি নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ট্রাম্প যা বলছেন, তাতে অনেকটাই স্পষ্ট যে আবার ক্ষমতায় এলে তাঁর নীতি হবে আগেরবারের চেয়ে ভয়ের। ট্রাম্পের সম্ভাব্য নীতি নিয়ে হাসান ফেরদৌসের দুই পর্বের বিশ্লেষণ। আজ থাকছে অভ্যন্তরীণ নীতি।
চারদিকে ফিসফাস শোনা যাচ্ছে, ট্রাম্প আসছেন, ট্রাম্প আসছেন! রিপাবলিকান সমর্থকেরা সে কথা ভেবে হাততালি দিচ্ছেন বটে, কিন্তু বাকি সবাই ভয়ে অস্থির। ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, যেসব রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি পত্রপত্রিকা ও টিভি তাঁকে ‘শাস্তি’ দিতে কলকবজা নেড়েছে, তাদের প্রত্যেককে তিনি দেখে ছাড়বেন। এ তালিকায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ছাড়াও দুই দলেরই সেসব সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্য রয়েছেন, যাঁরা তাঁর অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমস ও এনবিসি টিভির নাম আলাদা করে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘দাঁড়াও, দেখো তোমাদের কী অবস্থা করি।’ এ কাজে তিনি দেশের বিচার বিভাগকে ব্যবহার করবেন, এমন ইঙ্গিতও করেছেন।
আরও ভয়ের কথা, ট্রাম্প জানিয়েছেন তাঁর বিরুদ্ধে সব ধরনের প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ দমনে তিনি প্রয়োজনে ন্যাশনাল গার্ড, এমনকি সেনাবাহিনী পর্যন্ত ব্যবহার করবেন। প্রায় সোয়া কোটি অবৈধ অভিবাসীদের তিনি জোর করে, সামরিক শক্তি ব্যবহার করে বহিষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই লক্ষ্যে সীমান্ত এলাকায় বিশাল ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ নির্মাণের পরিকল্পনা তাঁর রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম যাত্রায় ট্রাম্প সামরিক শক্তি ব্যবহারের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মাদক পাচার থামাতে প্রয়োজনে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে তিনি বোমাবর্ষণ করবেন। তাঁর মন্ত্রিসভার কোনো কোনো দায়িত্বসম্পন্ন সদস্য, যাঁদের এখন আমরা পরিহাস করে ‘ঘরে বসা প্রাপ্তবয়স্ক’ (অ্যাডাল্ট ইন দ্য রুম) নামে ডেকে থাকি, তাঁদের আপত্তিতে তেমন ঘটেনি। কিন্তু নির্বাচিত হলে দ্বিতীয় যাত্রায় ট্রাম্প সেসব ‘প্রাপ্তবয়স্ক’দের বাদ দিয়ে অতি-অনুগত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। মার্কিন সেনাবাহিনীর একাধিক সাবেক জেনারেল এই সম্ভাবনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মধ্যে এক নম্বরে রয়েছেন ট্রাম্পের সাবেক চিফ অব স্টাফ জেনারেল জন কেলি ও সাবেক যৌথ বাহিনীর প্রধান মার্ক মিলি। তাঁরা দুজনই বলেছেন, ট্রাম্পের ব্যবহার নিঃসন্দেহে একজন ফ্যাসিস্টের মতো।
নির্বাচিত হলে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে শুধু যে কোনো ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ থাকছে না, তা-ই নয়। যদি সিনেট ও কংগ্রেস রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, যার সম্ভাবনা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, রাষ্ট্র পরিচালনায় ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের’ সুযোগও কমে আসবে। তা ছাড়া চলতি সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত, ফলে সবকিছুই ট্রাম্পের জন্য সোনায় সোহাগা।
প্রজেক্ট ২০২৫
নির্বাচিত হলে দ্বিতীয় যাত্রার ট্রাম্পের প্রশাসনের জন্য একটি দীর্ঘ ও বিস্তারিত ‘প্লে বুক’ বা নীলনকশা তৈরি করেছে রক্ষণশীল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন। এর নাম ‘প্রজেক্ট ২০২৫’। ট্রাম্প নিজে এ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত নন, এমনকি তা পড়েও দেখেননি বলেছেন, কিন্তু আমরা জানি যাঁরা এই নীলনকশা তৈরি করেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনের সদস্য। তাঁদের অনেকে এখন ট্রাম্পের প্রচারশিবিরের সঙ্গে জড়িত। ফলে মাছ দিয়ে শাক ঢাকার যত চেষ্টাই হোক, এ প্রকল্প যে ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
‘মেক আমেরিকা পুওর এগেইন’
নির্বাচিত হলে দ্বিতীয় দফায় তাঁর অভ্যন্তরীণ নীতিতে ট্রাম্প যে রণকৌশল অনুসরণ করবেন, তার কেন্দ্রে রয়েছে তিনটি স্তম্ভ: অতিধনীদের জন্য বর্ধিত হারে কর হ্রাস, উচ্চহারে আমদানি শুল্ক আরোপ ও বৃহৎ ব্যবসার স্বার্থে স্বাস্থ্য ও পরিবেশক্ষেত্রে বর্তমানে চালু বিধিনিষেধের শিথিলকরণ বা ডিরেগুলেশন। ২০১৭ সালে ক্ষমতায় বসেই ট্রাম্প দেশের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের জন্য যে কর হ্রাস বাস্তবায়িত করেন, তার ফলে জাতীয় ঋণের বোঝা প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পায়। এবার তিনি চীনসহ বিভিন্ন দেশের ওপর ২০ থেকে ৬০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের কথা প্রস্তাব করেছেন। বাড়তি আমদানি শুল্কের পক্ষে তিনি যুক্তি দেখাচ্ছেন, এর ফলে কোটি কোটি ডলার আয় হবে।
বাস্তব সত্য হলো, আমদানি শুল্ক রপ্তানিকারক দেশের চেয়ে আমদানিকারক দেশের ভোক্তাদেরই বেশি আঘাত করে। মার্কিন অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্কনীতি বাস্তবায়নের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ আগামী ১০ বছরে প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাবে। আর প্রতিটি ভোক্তাকে মাথাপিছু ২ হাজার ৬০০ ডলার অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে।
এসব দেখে কেউ কেউ বলছেন, ট্রাম্পের স্লোগান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ না হয়ে ‘মেক আমেরিকা পুওর এগেইন’ হলেই ঠিক হবে।
শুধু অনুগতদের জন্য
অভিবাসন প্রশ্নে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া এই প্রজেক্ট ২০২৫-এর সবচেয়ে ভীতিকর দিক হলো, ট্রাম্প প্রশাসন তার চোখে ‘যথেষ্ট অনুগত’ নয়, এমন বিবেচনা থেকে হাজার হাজার ফেডারেল কর্মকর্তাকে অপসারণ করার পরিকল্পনা। ট্রাম্প বরাবরই বলে এসেছেন, সরকারের ভেতর আরেক সরকার আছে, যাকে তিনি ‘ডিপ স্টেট’ নাম দিয়েছেন, যার সদস্যরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। প্রথমবার এদের সবাইকে ঝেঁটে বিদায় করতে পারেননি, কাউকে কাউকে করেছিলেন। এবার নির্বাচিত হলে সে ভুল হয়তো আর করবেন না।
সামাজিক ও নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে ট্রাম্প নির্বাচিত হলে। মুখে বলছেন বটে তিনি নারীর গর্ভপাতের অধিকার প্রশ্নটি প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের যার যার হাতে ছেড়ে দিতে চান। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্লেষকের ধারণা, কংগ্রেস তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকলে তিনি গর্ভপাতের ব্যাপারে একটি জাতীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন। শুধু তা-ই না, কোথায় কে কার সাহায্যে গর্ভপাতে করিয়েছেন, তার একজন হিসাবরক্ষকও থাকবেন। খোঁজ পাওয়া গেলে তাঁদের প্রয়োজনমাফিক শাস্তি দেওয়া হবে।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, নির্বাচিত হলে তিনি শিক্ষা দপ্তর বাতিল করবেন। আমেরিকার দক্ষিণপন্থী ও খ্রিষ্টবাদীরা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন, এ দেশে ক্লাসরুমে যা শিক্ষা দেওয়া হয় বা যা পড়ানো হয়, তা দেশের মূল্যবোধবিরোধী। আসলে তারা মূল্যবোধ বলতে খ্রিষ্টধর্মের কথাই বুঝিয়ে থাকে। এদের চাপের মুখে হাজার হাজার বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, পাবলিক লাইব্রেরি থেকে সেসব বই ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে আসা মানে এই খ্রিষ্টবাদীদের পোয়াবারো।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নেও ট্রাম্পের অনুসৃত নীতি ভয়ানক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। ট্রাম্প ও তাঁর অনুসারীরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নটি উদারপন্থীদের মস্তিষ্কপ্রসূত একটি বানোয়াট ব্যাপার। ২০২০ সালে তিনি একবার জলবায়ু প্রশ্নে প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, পরে বাইডেন এসে সে চুক্তিতে ফিরে যান। এবারও নির্বাচিত হলে যে ট্রাম্প সেই একই পথ ধরবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণের যুক্তি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, ক্ষমতায় আসামাত্রই তিনি আরও অধিক মাত্রায় তেল ও গ্যাস উত্তোলনের নির্দেশ দেবেন। তাঁর কথায়, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের একটাই পথ, তা হলো ‘ড্রিল বেবি, ড্রিল’।
ট্রাম্প কেন বিপজ্জনক, সে কথা ব্যাখ্যা করে কমলা হ্যারিস বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, লোকটি ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি আমেরিকার গণতন্ত্রকে ব্যাহত করতে ক্যাপিটল হিল আক্রমণ করেছিলেন। নিজ স্বার্থ পূরণের বাইরে তার অন্য কোনো আগ্রহ নেই। জন কেলির কথা ধার করে তিনি বলেছেন, ট্রাম্প আদ্যোপান্ত একজন ফ্যাসিস্ট।
আমাদের আর মাত্র এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে, এটা দেখতে যে আমেরিকা এ রকম একজন ফ্যাসিস্টকে তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করে কি না।