চাকরিতে কেন আগ্রহ নেই জেন–জি প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের
চাকরিতে কেন আগ্রহ নেই জেন–জি প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের
যুগে যুগে স্বাধীনচেতা মানুষেরা ধরাবাঁধা চাকরির চেয়ে ব্যবসা করতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। পৃথিবীতে এখন যে প্রজন্মকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাতামাতি হচ্ছে, সেই জেন-জি প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের এক ব্যাংকের সমীক্ষায় দেখা গেছে, জেন-জি প্রজন্মের বেশির ভাগ মানুষ ধরাবাঁধা চাকরির চেয়ে ব্যবসা করতেই বেশি আগ্রহী।
স্যানট্যানডার ব্যাংক যুক্তরাজ্যের সমীক্ষায় জেন-জি প্রজন্মের তরুণদের এ প্রবণতা উঠে আসে। সমীক্ষার তথ্যানুসারে, ৭৬ শতাংশ জেন–জি কারও অধীনে কাজ করতে আগ্রহী নন। ৯টা-৫টার একঘেয়ে কর্মজীবন তাঁদের পছন্দ নয়। জেন–জিদের ৭৭ শতাংশ বিশ্বাস করেন, তাঁদের ব্যবসা শুরু করার যোগ্যতা আছে।
ইয়াহু ফাইন্যান্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের প্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গে এখানে জেন–জিদের বড় ধরনের ব্যবধান দেখা যায়। তাঁরা নিজেই নিজের বস বা কর্তা হতে চান। অথচ মিলেনিয়ালদের মধ্যে এই প্রবণতা ছিল ৫৭ শতাংশ। জেনারেশন এক্সের মধ্যে ৩৬ শতাংশ ও বেবি বুমারদের মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশের মধ্যে এ প্রবণতা দেখা গেছে।
জেন–জি প্রজন্মের মানুষদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। মিলেনিয়াল হলেন তাঁরা, যাঁদের জন্ম ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে। জেন এক্সের মানুষদের জন্ম ১৯৬৫ থেকে ১৯৮০ সালে মধ্যে আর বেবি বুমারদের জন্ম ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে।
বেশির ভাগ জেন–জি মনে করেন, ডিজিটাল যুগে ব্যবসাসংক্রান্ত তথ্য ইন্টারনেটেই পাওয়া যায়। ডিজিটাল প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্ত তাঁদের ব্যবসার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধিতে অনুঘটকের কাজ করেছে। আগের প্রজন্মের হাতে সে সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। সে জন্য তাঁরা পড়াশোনা করে চাকরির খোঁজ করতেন ও দীর্ঘ দিন সেই চাকরি করে যেতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।
জরিপে অংশ নেওয়া ৩৯ শতাংশ বিশ্বাস করেন, স্মার্টফোন থেকে ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব। ৪৫ শতাংশ মনে করেন যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শোভন আয় করা যেতে পারে।
জেন–জি প্রজন্ম অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী ও প্রযুক্তিনির্ভর। ১৯৯৭ সালের আগে যাঁদের জন্ম, তাঁদের তুলনায় জেন–জিদের ব্যবসার প্রতি ঝোঁক অনেকটাই বেশি। এই প্রজন্মের তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। একসময় যেমন বেশি বেশি কাজ করা বা দীর্ঘ সময় অফিসে থাকার চল ছিল, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই প্রজন্ম বেরিয়ে আসছে।
অন্যান্য জরিপেও জেন–জিদের পছন্দের ধরনে পরিবর্তন আসার বিষয়টি ধরা পড়েছে। দেখা গেছে, ফ্রিল্যান্সিংয়ের জোয়ারের যুগে ৯টা-৫টা কাজের পরিবর্তে নিজেদের সুবিধাজনক সময়ে কাজ করতেই তাঁরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
চলতি বছর সান ফ্রান্সিসকো–ভিত্তিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস ‘আপওয়ার্ক’ যুক্তরাষ্ট্রের ১ হাজার ৭০ জন ‘জেন-জি’ প্রজন্মের মানুষের ওপর আরেকটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের সবাই ছিলেন ফ্রিল্যান্সার। দেখা যায়, ৫৩ শতাংশ জেন-জি সপ্তাহে গড়ে ৪০ ঘণ্টা অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ করেন। এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ জেন-জি কর্মী দুই বছরের বেশি সময় ধরে ফ্রিল্যান্সিং করছেন। তাঁরা সেটাই করে যেতে চান। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, পেশা বলতে এতকাল মানুষ যা বুঝেছে, সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে চান তাঁরা।
বিশ্লেষকেরা বলেন, জেন–জিদের এই মনোভাবের মূল কারণ হলো, পেশার ও পেশাগত বিকাশের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ। আরেকটি বিষয় হলো, নীতি-নৈতিকতাসংক্রান্ত পুরোনো ধ্যান–ধারণার পরিবর্তন। জেন-জিরা পুরোনো নীতি–নৈতিকতাসম্পন্ন কর্তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করবেন না বা কর্তাদের পছন্দের আলোকে ক্যারিয়ার গড়বেন না। সে কারণে তাঁরা ৯টা-৫টার প্রথাগত চাকরি ছুড়ে ফেলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।
জেন–জিদের মধ্যে যাঁরা প্রথাগত কাজ করছেন, সেখানেই তাঁদের স্বকীয় চিন্তার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ছোটবেলায় বয়স্করা তাঁদের সঙ্গে যেমন আচরণ করেছেন, অফিসে কেউ তাঁদের সঙ্গে সে রকম আচরণ করলেই বিপদ। দেখা যায়, তাঁরা আর সেই ব্যক্তির সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ পান না। অর্থাৎ জেন-জিরা বস হিসেবে বা জ্যেষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে কাউকে আলাদা করে দেখতে রাজি নন। সবার সঙ্গেই একই রকম আগ্রহ, উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করতে চান তাঁরা। পোশাকের বিধান মান্য করার ক্ষেত্রেও তাঁদের আপত্তি আছে।
করোনা মহামারির পর সামগ্রিকভাবে মানুষের চিন্তার জগতেও পরিবর্তন এসেছে। ২০২০ সালের পর উন্নত দেশের অনেক মানুষ চাকরি ছেড়েছেন। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৪ কোটি ৭০ লাখ মানুষ চাকরি ছেড়েছেন। এরপর ২০২২ সালে চাকরি ছাড়েন ৫ কোটির বেশি মানুষ। দেশটিতে এভাবে মানুষের গণহারে চাকরি ছাড়ার ঘটনা ‘গ্রেট রেজিগনেশন’ বা ‘গণহারে পদত্যাগ’ হিসেবে খ্যাত। এরপর অবশ্য সেই ধারা থেমে যায়। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে কর্মসংস্থানের পরিমাণ আবার প্রাক্-মহামারি পর্যায়ে ফেরত যায়। এরপরই শুরু হয় সিইওদের চাকরি ছাড়ার হিড়িক।